বুধবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক সহযোগীতা



১)

এবছর (২০১৩) জানুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহে গিয়েছিলাম উইনিপেগে, পানিসম্পদ নিয়ে একটি দুই দিনের কর্মশালাতে যোগ দান করতে। উইনিপেগ কানাডার ম্যানিটোবা প্রদেশের রাজধানী। কানাডার আলবার্টা, সাস্কাচোয়ান আর ম্যানিটোবা এই তিন প্রদেশকে একসাথে বলা হয়ে থাকে ‘প্রেইরী প্রভিন্স’।‘প্রেইরী’ শব্দটির আক্ষরিক অনুবাদ করা দুষ্কর, তবে এটি জলবায়ু ও ভূপ্রাকৃতিকগত দিক দিয়ে একধরনের সমতল অঞ্চল যেখানে গাছপালা তূলনামূলক ভাবে কম, মূলত তৃণভূমি, এবং জলবায়ু বেশ শুষ্ক। এই তিন প্রেইরী প্রভিন্সের সরকারী ক্ষেত্রে কর্মরত পানিবিজ্ঞাণী ও পানিপ্রকৌশলীদের নিয়ে এই কর্মশালার আয়োজন করেছে প্রেইরী প্রভিন্স ওয়াটার বোর্ড নামে কানাডার কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সংস্থাকানাডায় একেকটি প্রদেশের পানিসম্পদ তার নিজের, কিন্তু এই অঞ্চলের আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন চুক্তির নিরূপন, বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণের জন্য প্রেইরী প্রভিন্স ওয়াটার বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কর্মশালার মূল উদ্দেশ্য ছিল পানিসম্পদ বিষয়ক সাধারন সমস্যা নিয়ে প্রাদেশিক সরকারগুলোর পানিবিশেষজ্ঞদের মধ্যে সহযোগীতা বৃদ্ধি, সেই সাথে পানিসম্পদ ক্ষেত্রে এক প্রদেশের অর্জন অন্য প্রদেশের পানিবিশেষজ্ঞদের সাথে শেয়ার করা। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে আলবার্টা প্রদেশে কর্মরত, কিন্তু কর্মশালাটিতে যোগ দিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই তিন প্রদেশের পানিসম্পদগত বিভিন্ন সমস্যা, সমাধানের উপায় ইত্যাদি সম্পর্কে বেশ ভাল একটি ধারনা পেলাম।
২) 

এতক্ষণ শীবের গীত গাইলাম, এবারে ধান ভানায় ফিরি। উপরের অনুচ্ছেদে যে গুটি কয়েক তথ্য দিলাম তার একটু বিশ্লেষণ করি। এক, একটি অভিন্ন দেশ হলেও তার নিজস্ব প্রদেশসমূহের মধ্যে পানিসম্পদ নিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ ও তা নিরোধনে চুক্তি থাকে এবং পারস্পরিক সহযোগীতার জন্য একটি সাধারণ সংস্থা থাকতে পারে যা কিনা এই সমস্যাগুলো নিরসনে বা পারস্পরিক সহযোগীতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করবে দুই, সাধারন অববাহিকা অঞ্চলের পানিবিশেষজ্ঞদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগীতা ও তথ্যপ্রবাহ সামগ্রিক ভাবে আঞ্চলিক উন্নয়নের পথে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে থাকে। এর কারন একটাই, আর তা হলো নদী অববাহিকার সীমারেখা, তা একই দেশে বিভিন্ন প্রদের মধ্যেই হোক বা এক বা একধিক দেশের মধ্যেই হোক, কখনো রাজনৈতিক সীমারেখা মেনে চলেনা। ভূপ্রাকৃতিকগত দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান নদী অববাহিকার একদম শেষে, অন্যদিকে নেপাল, ভারত ও চীনের অবস্থান একদম উজানে যেখানে নদীর জন্ম হয়েছে, অথবা মাঝামাঝি। এছাড়া বাংলাদেশের কয়েকটি নদী এসেছে মায়ানমার থেকে। বাংলাদেশের পানিসম্পদ নিয়ে দ্বিপাক্ষিক সহযোগীতার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে ভারত ও মায়ানমারের সাথেএকই সাথে যেহেতু বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র ( বা যমুনা) নদীর অববাহিকায় রয়েছে চীন, ভারত, তিব্বতের অঞ্চল এবং গঙ্গা ( বা পদ্মা) নদীর অববাহিকায় রয়েছে নেপাল ও ভারতের অঞ্চল, সেহেতু এই সবকয়টি দেশই বাংলাদেশের পানিসম্পদের সমস্যা সমাধান ও উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অন্যভাবে বলতে গেলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই দেশগুলিকে নিয়ে একটি আঞ্চলিক পানি বোর্ড গঠনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।

৩) 

প্রশ্ন উঠতে পারে এক ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক পানিসমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেই এত কাঠখড় পোহাতে হয় সেখানে এতগুলো দেশ নিয়ে আঞ্চলিক পানি বোর্ড গঠন কতটা বাস্তবিক চিন্তাভাবনা? আমার ব্যাক্তিগত মত, এটি মোটেই কোন আকাশ-কুসুম কল্পনা নয়। এই এশিয়াতেই মেকং নদী কমিশন এরকম আঞ্চলিক একটি সংস্থার জলজ্যান্ত উদাহরণ। এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন নদী গুলোর পানিবন্টন নিয়ে কাজ করা ইন্দো-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনও ছোট আঙ্গিকে একটি আঞ্চলিক সংস্থা। প্রস্তাবিত আঞ্চলিক পানি বোর্ড গঠনের বেশ কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। বাংলাদেশ যেমন ভারতের ভাটিতে, তেমনি ভারত চীনের ভাটিতে অবস্থিত। বাংলাদেশ-ভারত অভিন্ন নদীর পানিবন্টনের ক্ষেত্রে ভারতকে যতটাই উদাসীন দেখা যায়, একই রকম ইস্যুতে চীনের সাথে ভারত ঠিক ততটাই উদ্বিগ্ন থাকে। ভারত উজানে কোন পানিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে বাংলাদেশে তার কি বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে সেটি যেমন ভেবে দেখবার প্রয়োজন বোধ করেনা, ঠিক বিপরীত ক্রমে অভিন্ন কোন নদীর ক্ষেত্রে চীন যদি উজানে কোন প্রকল্প হাতে নেয় ভারত তাকে মনে করিয়ে দেয় যে ভারতের স্বার্থের যেন তাতে বিঘ্ন না ঘটে। ভাটি আর উজানে অবস্থিত এই দুই দেশের সাথে একই ধরনের ইস্যুতে ভারতের এই দ্বৈত অবস্থান এটাই মনে করিয়ে দেয় সব দেশই তার নিজের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করে। কিন্তু পানিসম্পদ নিয়ে অন্তর্জাতিক কনভেনশনে পানিসম্পদ ইস্যুতে সাম্যতার কথা বলা আছে, হোক তা নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েই। তাই একটি আঞ্চলিক পানি উন্নয়ন বোর্ড হলে একই টেবিলে সব কয়টি পক্ষের সামনে এরকম দ্বৈতস্বত্ত্বার প্রদর্শন ভারতের জন্য কঠিক হবে বৈকি। এছাড়া, গঙ্গা পানিবন্টন চুক্তির আলোচনার শুরু থেকেই গঙ্গাতে পানির প্রবাহ বৃদ্ধির বাংলাদেশের একটি প্রস্তাব ভারত বিরোধীতা করে আসছে। এই প্রস্তাবটি হলো গঙ্গা নদীর উজানে নেপালে বাঁধ দিয়ে বর্ষা মৌসুমে পানি সঞ্চয় করে শুষ্ক মৌসুমে তা প্রবাহিত করার। এতে দুইটি সুফল আছেঃ এক, ফারাক্কায় শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে যা কিনা ২০২৬ সালের পরে ( ২০২৬ সালে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে) পুনরায় গঙ্গা চুক্তির নবায়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে, দুই, আঞ্চলিক সহযোগীতার ভিত্তিতে নেপালে বাঁধের সাথে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হলে তার সুফল তিন দেশই ভোগ করতে পারবে।
৪)

পানিসম্পদ নিয়ে আঞ্চলিক সহযোগীতা বৃদ্ধির জন্য আঞ্চলিক পানি বোর্ড গঠনের স্বপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে উপরের অনুচ্ছেদগুলিতে কেবল সংকট বা বিরোধ নিষ্পত্তির কথাই বলা হলো। এবারে ভিন্ন প্রসংগে আসি। বাংলাদেশের পানিসম্পদের অধিকাংশই আসে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার মাধ্যমে। এই অববাহিকা চীন, নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশ এই সবগুলি দেশ নিয়ে বিস্তৃত। এই অববাহিকার পানিচক্র বা হাইড্রোলজিকাল সাইকেলর ভৌত প্রক্রিয়াগুলোকে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপনের জন্য প্রয়োজন একটি কার্যকরী গাণিতিক মডেল। এই মডেল একই সাথে অববাহিকার বর্তমান অবস্থাকে উপস্থাপন করবে, সেই সাথে এই অববাহিকার সম্ভাব্য জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সার্বিক পানিসম্পদের উপর তার কিরূপ প্রভাব পড়বে সেটি নিরূপনের জন্য ব্যবহৃত হবে। এরকম একটি গানিতিক হাইড্রোলজিকাল মডেল তৈরী করতে প্রয়োজন প্রচুর উপাত্তের যার প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে আঞ্চলিক সহযোগীতার অভাব। যেহেতু এই অঞ্চলের অববাহিকাগুলোর জন্য আঞ্চলিক কোন সংস্থা নেই তাই দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক কোন উপাত্ত জনসাধারণত দূরের কথা হয়ত সরকারগুলোর কাছেও নেই। অথচ এই উপাত্তগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত হলে এই অঞ্চলের পানিবিশেষজ্ঞদের গবেষণা এবং সর্বোপরি আঞ্চলিক পানিসম্পদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে তা অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। প্রস্তাবিত আঞ্চলিক পানি বোর্ড গঠিত হলে তা এই অঞ্চলের একটি তথ্য ও উপাত্ত ভান্ডার হিসেবেও কাজ করবে।
৫) 

এবছর জানুয়ারী মাসে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল নেটওয়ার্ক (বেন) এর যৌথ আয়োজনে ঢাকায় হয়ে গেল দক্ষিণ এশীয় পানিসম্পদ নিয়ে কয়েকদিন ব্যাপি আন্তর্জাতিক একটি কনফারেন্স। ব্যক্তিগত ভাবে এই কনফারেন্সে যোগদান করতে পারিনি, তবে গঙ্গা চুক্তি নিয়ে আমার, ডঃ মোঃ খালেকুজ্জামান ও সারফরাজ আলমের যৌথ লেখা একটি প্রবন্ধ এতে উপস্থাপিত হওয়াতে খুব কাছে থেকে এর কার্যক্রম দেখা হয়েছে যে মূল বিষয়টি এই কনফারেন্সে উঠে এসেছে তা হচ্ছে এই অঞ্চলের দেশগুলির মধ্যে রাজনৈতিক ভাবে যেরকম মতবিরোধই থাকুকনা কেন, সার্বিক পানিসম্পদের উন্নয়নের জন্য এই দেশগুলির মধ্যে সহযোগীতার কোন বিকল্প নেই, অন্তত বৈজ্ঞানিক মহল সেটাই মনে করে। প্রস্তাবিত আঞ্চলিক পানি বোর্ড স্থাপন সেই সহযোগীতা বৃদ্ধির একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিবে বলে আমার বিশ্বাস।

ডঃ জাহিদুল ইসলামঃ পানি বিশেষজ্ঞ ও লেখক। 

বিদ্রঃ লেখাটি গত ৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৩ তে বিডিনিউজ২৪ এর মতামত বিশ্লেষণে প্রকাশিত হয়েছে। 
লিঙ্কঃ এইখানে