বৃহস্পতিবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

একজন নিভৃতচারী মানুষের গল্প

উৎসর্গঃ জাহিদুল ইসলাম গনী

'আমার এই দু’টি চোখ পাথরতো নয় তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়
কখনো নদীর মত তোমার পথের পানে বয়ে বয়ে যায়.................'
  সুবীরনন্দীর গাওয়া এই অসম্ভব সুন্দর গানটি শোনেননি অথবা পছন্দ করেননা এমন বাংলা গানের শ্রোতা পাওয়া দুস্কর।বাংলা গানের একজন নেশাছন্ন শ্রোতা হিসেবে গানটি আমারো পছন্দের তালিকায় বেশ উপরের দিকে।এই গানটিকে আমরা চিনি সুবীরনন্দীর গান হিসেবে কিন্তু এটির রচয়িতার কোন খাবর কি আমরা কখনো রেখেছি? কেউ কি জানি কি অবহেলা আর অনাদরে গান রচনা থেকে নিজেকে বিরত রেখে আজ এক নিবিড় পল্লীতে একেবারে সাধারন মানুষের মত জীবন যাপন করছেন অসম্ভব মেধাবী এই কবি? আমার আজকের লেখনীর প্রয়াস সেই মানুষটিকে নিয়ে।


আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগের কথা।গনী ভাই এর সাথে আমার পরিচয় আমার বড়বোনার বিয়ের সময়।পুরো নাম আমার নামের মতই জাহিদুল ইসলাম গনী।আমার দুলাভাই এর দূর সম্পর্কের দুলাভাই, সেই হিসেবে ভাই সম্মোধন করেই আলাপ শুরু। গ্রামের আর দশটা সাধারন মানুষের মতই জীবন যাপনে অভ্যস্থ এই মানুষটিকে প্রথম দর্শনে আমার বিশেষ কিছু মনে হয়নি তাই স্বাভাবিক ভাবে কেমন আছেন কি করছেন এই ধরনের সৌজন্যমূলক আলাপচারিতার বেশি আর কিছু গড়ায়নি।যাই হোক যেদিনের কথা বলছিলাম সেটা বিয়ের দিন। গনি ভাই আমার বোনের সাথে পরিচয় হলেন, কথা বললেন, দুলাভাই সুলভ ঠাট্টা মশকরা করলেন এবং যথারীতি অনুষ্ঠান শেষে চলে গেলেন।পরের দিন বৌভাত উপলক্ষ্যে আমরা সবাই মিলে মজা করতে করতে গেলাম ভুঞাপুর থানার গোলাবাড়ী নামক স্থানে আমার আপূর শশুরবাড়ীতে।আপুর পাশে বসে গল্প করছি এমন সময়ে সেখানে গনী ভাই এর আবির্ভাব। হাতে ছোট্ট একটি কাগজ আমার আপুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ঝর্না তোমার আর মনি(আমার দুলাভাই এর নাম)কে নিয়ে শুভকামনা জানিয়ে একটা কবিতে লেখেছি পড়ে দেখ। চলে যাবার পড়ে আমি আপুর কাছ থেকে কাগজটা নিয়ে দেখলাম, লম্বা সাইজের কাগজে পুরো দুই পৃষ্ঠা জুড়ে রচনা এবং এককথায় অসাধারন। মুহুর্তের মধ্যে আমি মানুষটির সম্মন্ধে বেশ উৎসাহ বোধ করলাম এবং বেশ আলাপ জমিয়ে ফেললাম। থাকেন পাশের গ্রামেই, একটি বেসরকারী স্বাস্থসেবা কেন্দ্রে চাকুরী করেন, বিয়ে করেছেন বেশ আগে, একটি ছেলে আছে গ্রামের স্কুলেই পড়াশুনা করে।কিছু আলাপচারিতা হলোঃ

লেখালেখি করে থেকে করছেন ?
‘সে প্রায় অনেক দিন থেকে, ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি করি’
মূলতঃ কি কি লেখেন?
‘কবিতা কখনো গান’
বই বের করেছেন ?
‘সে সূযোগ কখনো পাইনি, নিজের আনন্দে লিখি’
আর গান নিয়ে ?
‘নিজেই লিখি, অনেক সময় সুর দেই, মাঝে মাঝে গাইতে চেষ্টা করি’
কখনো রেডিও বা টিভি তে পাঠান নাই?

এই পর্যায়ে গনী ভাই একেবারে চুপ। আমি বিব্রত হই, ভাবি জিজ্ঞেস করা কি ঠিক হল? কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন, ‘কষ্টের কথা মনে করিয়ে দিলে ভাই’। আমি বলি কিসের কষ্ট? আরো কিছুক্ষন মিয়ম্রান থেকে গনী ভাই বলে ‘অনেক গান রেডিওতে বা টিভিতে পাঠাইছি, কিন্তু ওরা আমাকে তেমন কিছু জানাইনাই।হঠাৎ একদিন শুনি আমারি লেখা একটি গান রেডিও তে বাজতেছে। আমি অপেক্ষা করলাম কানটি কার লেখা শুনার জন্য, দেখি অন্য একজনের নাম।এত কষ্ট পেয়েছিলাম সেই দিন তা আর বলার মত না। তার পর থেকে আর পাঠাইনা। নিজের জন্য লিখি। তবে দু’একটা গান আমার নামেও দিছে এবং তার জন্য কিছু টাকাও পাইছি নামে মাত্র’

আমি বলি আপনার লেখা কোন গানের নাম মনে আছে?

‘একটা গান খুব বিখ্যাত হইছিল ওই যে সুবীরনন্দী গায় গানটা, আমার এই দু’টি চোখ পাথরতো নয় তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায় কখনো নদীর মত তোমার পথের পানে বয়ে বয়ে যায়’

আমি আমার নিজের কানকে বিশ্বাষ করতে পারছিনা।এরকম একটি অসম্ভব জনপ্রিয় আর শাশ্বত গানের স্রষ্টার পাশে আমি বসে আছি? সময়টা ১৯৯২ আমি তখন নবম শ্রেনীর ছাত্র, তারুন্যের উম্মাদনায় তখনকার ব্যান্ড সংগীতের স্বর্নযুগের মানুষ আমি, কিন্তু এইসব গানত তার আগেই আমার রক্তে, মজ্জায় ঢুকে গেছে। বাসায় আপু গান শুনত আর গুন গুন করে গাইত সেই সাথে আমিও। সেই সব গানের একটিত এটাও আর সেই গানের গীতিকার পড়ে আছেন এই অজপাড়াগায়ে? কতৃপক্ষের অবহেলায়, অনাদরে, শঠকারীতায় নিজেকে আড়াল করে রেখেছে এই ভাবে? আমি আমার মনকে মানাতে পারিনা বড্ড বেশী আবেগ তাড়িত হয়ে যাই। বিয়ে বাড়ীর আনন্দ আমার কাছে ম্লান হয়ে যায়।আমি গনী ভাইকে বলি আর কখনো লিখবেননা? ঝটপট উত্তর ‘না’

সেদিন অনেক রাতে বাসায় আসি।মনটা আশান্ত থেকেই যায়। মধ্যবিত্ত পরিবারে ভাই বোনের মাটির ব্যাংকে জমানো টাকা দিয়ে কেনা ক্যাসেট প্লেয়ারে গানটা ছেড়ে দিয়ে আমি বাতি নিভিয়ে বসে থাকি………



Get this widget | Track details | eSnips Social DNA